Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

স্বাধীনতা সংগ্রামে চকরিয়া

 

      ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের পলিমাটির সৌরভের এই ভূ-খন্ডে, ইতিহাসের কোন লগ্নটিতে আমাদের জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল, তা নিরুপন দুরহ। স্বাধীনতার চেতনাবোধের উৎস রয়েছে মানুষের অনুভূতির সুগভীরে। এই ভূখন্ডের মানুষের হাজার বছরের ইতিহাসের তাদের জাতীয়তা বোধের চেতনাকে সঞ্জীবিত করেছে ইতিহাসের বিভিন্ন লগ্নে স্রোতধারা। হাজার বছরের ইতিহাসের চড়াই উতরাইয়ে আহৃত অভিজ্ঞতা আর অনুভুতিতে দানা বাঁধা আমাদের জাতীয়তাবোধকে আলোকিত করেছে অতীশ দীপঙ্করের জ্ঞানের প্রদীপ, মধুর করেছে চন্ডীদাসের আলাওলের গান ও কবিতা, অটল করেছে হযরত শাহ্জালালের বিশ্বাস, উদ্বুদ্ধ করেছে রবীন্দ্র নজরুলের শতরুপে সাজানো জাদুকরি আমাদের বর্ণমালা। এসবের প্রেরণা সমুদ্রের ঢেউয়ের মতই উত্তাল উদ্দামে এগিয়ে নিয়ে গেছে আমাদের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রাম। শুধু স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, ব্রিটিশ বিরোধী প্রতিটি আন্দোলনে চকরিয়াবাসীর ভূমিকা ছিল স্বতঃস্ফুর্ত ও কার্যকরি।

      যার স্বাক্ষ্য বহন করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড সুরেশ চন্দ্রের সাথে মাষ্টারদা সূর্যসেন, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস, তারেকেশ্বর, সুকেন্দু দত্ত সহ বহু বিপস্নবী নেতা চকরিয়ায় আত্মগোপন করেছিলেন এবং চকরিয়া থেকে ব্রিটিশ বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। ৭১এর স্বাধীনতা সংগ্রামে ৭ই মার্চ রেসকোর্সের আহবান এবং ২৬শে মার্চের কালুঘাটের আহবানে মাতৃভূমি রক্ষার তাগিদে চকরিয়াবাসী থেমে থাকেনি। অন্যান্য আন্দোলনের মত স্বাধীনতা সংগ্রামে চকরিয়া বাসীর অংশগ্রহণ স্বাধীনতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৭১সালের ১০ মার্চ দেশপ্রেমিক চকরিয়া বাসীর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ সুগম করার লক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদ এবং স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম চকরিয়া থানা গঠন করে। তথ্য উপাত্ত যতটুকু জানা যায় সর্বপ্রথম এসকে শামসুল হুদাকে সভাপতি এবং প্রাক্তন জাতীয় সংসদ সদস্য ডা: শামসুদ্দিন চৌধুরীকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মন্ডিত করে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়।

যে তিনজন ব্যক্তি সংগ্রাম পরিষদের সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন তারা হচ্ছেন আলহাজ্ব আনোয়ার হোসেন, শামসুল হুদা বিএসসি, হাজী আবু তাহের। মফজল আহমদ ও মাষ্টার আবদুল মালেক কোষাধ্যক্ষ ও সহ কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন। জমির উদ্দিন ও তাহের আহমদ সাংগঠনিক ও দপ্তর সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতঃপর আনোয়ারুল ইসলাম চৌধুরী বাবু মিয়া, মাষ্টার আবদুল মালেক, মফজল আহমদ, মোজাম্মেল হক বিএ অধ্যাপক মমতাজ আহমদ চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন বাঙ্গালী, হাবিলদার গোলাম কাদের, হাবিলদার আবুল কালাম, মৌলানা নজির আহমদ প্রমুখ সংগ্রাম পরিষদের সার্বিক তত্তবাবধানে ছিলেন। সংগ্রাম কমিটি গঠনের অব্যবহিত পরে আনোয়ারুল হাকিম দুলালকে আহবায়ক করে সিরাজুল হক, এনামুল হক, সাহাবুদ্দিন, রেজাউল করিম চৌধুরী, খায়রম্নল আলম, আনোয়ার হোসাইন, শিবিবর আহমদ, গিয়াস উদ্দিন, আবু তাহের এবং শামসুল আলমকে সদস্য করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এই কমিটির সার্বিক তত্তাবধানে ছিলেন এ এইচ এম সালাহ্ উদ্দিন মাহমুদ, নুরুল আবছার এবং নাছির উদ্দিন। ১০ই মার্চ থেকে ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্বদিন পর্যমত্ম প্রায় ২ হাজারের অধিক লোক চকরিয়ায় প্রশিক্ষণ শিবির থেকে গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ করেছিল বলে জানা যায়।   

              ২৩মার্চ চকরিয়া বিমান বন্দরের সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রবীনদের ভাষ্যমতে তখনকার সময় উক্ত জনসভায় দশহাজারের অধিক লোকের সমাগম হয়েছিল। মুলত জনসভার পর থেকে চকরিয়াবাসী স্বাধীনতা উত্তাল স্বপ্নের ব্যাকুল মদিরতায় আরো গভীর সংকল্পের  ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ এর ঐতিহাসিক ভাষণের নির্দেশ মাথায় ও হৃদয়ে ধারণ করে তিনি চকরিয়ায় এলেন মুক্তিকামী জনতাকে সংঘটিত করতে।এস. কে শামসুল হুদা ও ডা. শামসুদ্দিনের নেতৃত্বে গঠন করলেন সংগ্রাম কমিটি । ২৭ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভারী অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে চকরিয়ার সংগ্রামী জনতার প্রতিরোধ ভেদ করে অতর্কিত হামলা চালায়। হানাদার বাহিনী চকরিয়ায় প্রবেশ করার সাথে পাকি দোসরদের চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। প্রথমেই তারা লুট ও যুবতী নারীদের ধরে ধরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে ভোগের সামগ্রী হিসেবে তুলে দিলো। হাবিলদার আবুল কালামের প্রশিক্ষণে শহীদ আবদুল হামিদ, মাহবুব, জহিরুল ইসলাম সিদ্দিকী, নজির আহমদ প্রমূখ অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রথমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সীমিত শক্তি নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করেছিলেন কিন্তু পরে যখন বুঝলেন যে, অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে টিকে থাকা সম্ভব নয়।আরো প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রয়োজন তাই তারা ভারতে গিয়ে গেরিলা প্রশিক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয়। বাংলাদেশ বিনির্মানের দীপ্ত শপথে অপ্রতিরম্নদ্ধ হয়ে উঠে তাদের মন ও মনন। সিপাহী এনামুল হক ২ শে মার্চ কালো রাতে ১২জন বাঙালী সিপাহীসহ পাক বাহিনীদের হাতে বন্দী হন। ২৬শে মার্চ তাদেরকে হত্যা করার জন্য টাকা যোগে আগ্রাবাদ নিয়ে যাবার পথে কৌশলে ট্রাক ড্রাইভারকে হত্যা করে ট্রাকসহ সুদুর টেকনাফে চলে আসেন। কেরানী পাড়ার যুদ্ধে পাক বাহিনীর ঘাটি ধ্বংসের অভিযানের সময় সিপাহী এনামুল হক শহীদের মিছিলে শামিল হন। পালাকাটা গ্রামের শহিদ সিপাহী গোলাম কাদেরকে ৭১এর ২৫ শে মার্চ গভীর রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনা নিবাসে গুলি করে হত্যা করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে ভারী অস্ত্র নামানোর বিষয়ে অগ্নিঝরা প্রতিবাদকারীদের অন্যতম ছিলেন হারবাং ইউনিয়নের সন্তান শহীদ গোলাম সত্তার। ২৮ শে মার্চ সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্তে শহীদ হাবিলদার আবুল কালাম, নায়েক বদিউল আলম, নায়েক আশরাফ, হাবিলদার গোলাম কাদের, মোজাম্মেল হক, শামশুল হুদা, শের আলম, শাহনেওয়াজ, আনোয়ার হোসেন বাঙালী, খলিলুর রহমান, আবুল কাশেম প্রমুখ যোদ্ধারা চকরিয়া থানায় এক সাহসী হামলা চালিয়ে ১১টি ৩০৩টি রাইফেল ছিনিয়ে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিয়ে আসে, ৩০ মার্চ চকরিয়া থেকে সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ৫ট্রাক খাদ্যশস্য চট্টগ্রাম রেস্ট হাউজ, পটিয়া, কালুরঘাট, ও অন্য কয়েকটি এলাকায় অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সাহায্য হিসাবে পাঠানো হয়। ১৮ই এপ্রিল মোজাম্মেল হক বিএ এর নেতৃত্বে আরেক দল মুক্তিবাহিনী একটি সাদা টয়োটা কারসহ চারজন সশস্ত্র লোককে গ্রেফতার করেন। এর মধ্যে দুজনকে চিরিংগা বাস ষ্টেষনে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং বাকী দুজনকে ফাঁসিয়াখালী ঢালায় গুলিকরে আহত করা হয়।